রাজশাহী বিভাগীয় চীফ : বর্ষায় বেড়েছে পদ্মা নদীর পানি। মৃতপ্রায় নদী আবার হয়ে উঠেছে প্রমত্তা। নদীর সেই পানি কলকলিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এবার দেখা দিয়েছে ভাঙন। রাজশাহী মহানগরীসহ জেলার গোদাগাড়ী, বাঘা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নদীতে নেমে গেছে কয়েক’শো বিঘা আবাদী জামি এবং অনেক গাছপালা।
পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের এমন খেলা দেখে ঘুম হারাম হয়ে গেছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্তত ২৫ গ্রামের মানুষের। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহুর্ত তাদের কাটছে আবাস হারানোর আতঙ্কে। রাজশাহী নগরীর বুলনপুর এলাকায় গত বছর থেকে ভাঙন দেখা দেয়ায় সেখানে শুরু হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ব্লক বানানোর কাজ।
তবে সেসব ব্লক দিয়ে এখন আর কিছুই হবে না। ব্লক বসাতে হলে আবার অপেক্ষা করতে হবে পানি কমে যাওয়া পর্যন্ত। এছাড়া ভাঙন রোধে বর্তমানে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় শুধু বালুর বস্তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ভাঙন ঠেকাতে এর বাইরে কোথাও কোনো প্রস্তুতিও নেই পাউবোর। ফলে এবার বাসস্থান থাকে কি না, সে চিন্তাতেই দিন কাটাচ্ছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর রাজপাড়া থানার বুলনপুর থেকে পশ্চিমে নবগঙা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় একটু একটু করে ভাঙন শুরু হয়েছে। তবে নগরীর বসুড়ি এলাকায় ভাঙনের পরিমাণ একটু বেশি। এই এলাকায় গত বুধবার থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বসুড়ি এলাকার বাসিন্দা বাবু শেখ (৩৫) বলেন, ভাঙনে এরই মধ্যে তাদের বাগানের ৪টি লিচু ও একটি আম গাছ নদীতে ভেসে গেছে। আরেকটি আমগাছের গোড়ায় ভাঙন এসেছে। তাই গাছটিকে রশি দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। এরপর সেটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। এ এলাকায় গত দু’দিনে প্রায় পাঁচ মিটার নদীর পাড় ভেঙেছে বলেও জানান তিনি।
বসুড়ি এলাকার পূর্বেই নগরীর জিয়ানগর এলাকা। জিয়ানগরের নদীপাড় থেকে প্রায় ৩০০ মিটার উত্তরেই নির্মাণ করা হচ্ছে রাজশাহীর মানুষের স্বপ্নের ‘বঙ্গবন্ধু সিলিকন সিটি’। গতবছর এ এলাকাটি অনেকটাই ভেঙেছে। এবারও একটু একটু করে ভাঙছে বলে জানিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা।
শনিবার সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উজান থেকে পদ্মার পানি এসে ধাক্কা খাচ্ছে পাড়ে। এরপর পানি স্রোত চলে যাচ্ছে নদীর মাঝে থাকা একটি চরের দিকে। পানির ধাক্কায় সে চরও কাটছে। এছাড়া গত ক’দিনের ভারি বর্ষণের পানি নামার সময় নবীনগর এলাকার একটা ড্রেনের মুখ ঢলে কাটছে। প্রায় ১০ মিটার এলাকা নদী থেকে ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে।
জিয়ানগর এলাকার বাসিন্দা জালাল উদ্দিন (৬০) বলেন, বসুড়ি এলাকায় নদীর পাড় থেকেই বালু তোলা হয়। শুষ্ক মৌসুমে বালু তুলে নিয়ে যায় ট্রাক। আর ভরা মৌসুমে ড্রেজারের সাহায্যে বালু তোলা হয় নৌকায়। এর ফলে নদী ভেঙে ক্রমাগত উত্তরের দিকে যাচ্ছে। এবারও এর প্রভাবে বুলনপুর, নবগঙা, বসুড়ি, নবীনগর ও জিয়ানগরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তারপরেও বন্ধ হচ্ছে না বালু উত্তোলন।
এদিকে পানির তোড়ে উপজেলার সারাংপুর, গাঙোবাড়ি ও সুলতানগঞ্জ এলাকায় পদ্মার পাড় ভাড়ছে। এছাড়া ভাঙতে শুরু করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কলিমপাড়া, আমিনপাড়া, লুটারুপাড়া, সরকারপাড়া, বকচর ও দেবীনগর এলাকা। ভাঙন দেখে এসব এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
এছাড়াও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের আলাইপুর, পানি কামড়া ও চরকালদাসখালি এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এসব এলাকার কয়েক’শো বিঘা আবাদী জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভেসে গেছে অনেক গাছপালাও। তবে ভাঙন রোধে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
পাউবো জানিয়েছে, গত ১০ জুলাই থেকে পদ্মার পানি বেশি পরিমাণে বাড়ছে। ওই দিন রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১২ দশমিক ৯২ মিটার। সর্বশেষ শনিবার সকাল ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৫ দশমিক ১৫ মিটারে। এর আগের দিন সন্ধ্যা ৬টায় পানির উচ্চতা পাওয়া যায় ১৫ দশমিক ৯ মিটার। ওই দিন সকাল ৬টায় ছিল ১৪ দশমিক ৯৯ মিটার।
এরও আগে গত বৃহস্পতিবার সকালে পানির উচ্চতা ছিল ১৪ দশমিক ৪৩ মিটার। ওই দিন সন্ধ্যায় পানির উচ্চতা হয় ১৪ দশমিক ৭৮ মিটার। এক রাতেই পানি বেড়েছে ৬ সেন্টিমিটার। তবে এতে এখনও উদ্বেগের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন পদ্মার পানি পরিমাপক এনামুল হক।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। সে অনুযায়ী পদ্মার পানি এখনও বিপদসীমার ৩ দশমিক ৪১ মিটার নিচে। এবার বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা থাকলেও এখনই ভয়ের কিছু নেই। তবে পানির উচ্চতা ১৮ মিটার অতিক্রম করলেই রাজশাহীর নি¤্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলেও জানান পাউবোর এই কর্মকর্তা।
এনামুল হক জানান, গেল ১৫ বছরে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে মাত্র দুই বার। এর মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। কেবল ২০০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ মিটার।
এর পর ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মা বিপদসীমা অতিক্রম করে। ওই বছর পদ্মার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৭০ মিটার। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট রাজশাহীতে পদ্মার পানির প্রবাহ উঠেছিল সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৪১ মিটার। এতেই বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে শহরে পানি ঢুকতে শুরু করে। নদীতে বিলীনও হয় অনেক এলাকা। এবার একটু আগে আগেই দেখা দিয়েছে ভাঙন।
পাউবোর রাজশাহীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানান, গতবছর নগরীর টি-গ্রোয়েন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা সংস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়ে তারা সোয়া দুই কোটি টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু পাওয়া গেছে ৫০ লাখ টাকা। সে টাকাই বর্তমানে টি-বাঁধে জিওব্যাগ ফেলার কাজ চলছে। তবে অন্য কোনো এলাকার ভাঙন রোধে সেখানে জিওব্যাগ ফেলার মতোও কোনো টাকা নেই।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মাপাড়ে ভাঙন, আতঙ্কিত মানুষ

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। পাঠকের মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। লেখাটির দায় সম্পূর্ন লেখকের।